শীত মৌসুম যেতে না যেতেই ঢাকার দুই সিটিতেই বেড়েছে মশার উপদ্রব। বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই মশার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বর্ষার আগেই মশা বেড়ে যাওয়ায় নগরবাসীকে তাড়া করছে গত ডেঙ্গু মৌসুমের ভয়। মশকনিধনে এখনই কার্যকর ওষুধ ছিটানোর কর্মসূচি হাতে না নিলে এবার গেল মৌসুমের ভয়াবহতা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ঢাকায় যে পরিমাণ মশার ক্ষেত্র শুধু ওষুধ ছিটিয়েই তা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে ভাষ্য সিটি করপোরেশন কর্মকর্তার।
গত মৌসুমে (আগস্ট-নভেম্বর) এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে আক্রান্ত হয়ে কয়েক লাখ মানুষ চিকিৎসা নেন। ওইসময় মশার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে তৎপর হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সমালোচনা হয় মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও। ডেঙ্গু ভয়াবহতার মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে হয় উচ্চ আদালতকেও। সরকারি হিসাবেই বলা হয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৩৩ জনের।
সবশেষ ঢাকা সিটি নির্বাচনকে ঘিরে গত জানুয়ারি থেকেই মশক নিধন কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দেয়। জোরালোভাবে ওষুধ না ছিটানোর ফলে রাজধানীজুড়েই মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। আর চলতি মার্চে এসে সেই উপদ্রব এখন আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। ফলে নগরবাসী দিন পার করছেন গত মৌসুমের ভয়াবহতা ভেবে। গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থীদের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল মশামুক্ত রাজধানী উপহার দেয়া।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে রাজধানীর সড়ক, খাল, জলাধার থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতে মশার যন্ত্রণায় বিরক্ত নাগরিকরা। সমস্যা সমাধানে একাধিক আশ্বাস ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষের সেবার ফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ ঢাকাবাসীর। অপরদিকে করপোরেশন বলছে, সকলের সম্পৃক্ততা ছাড়া কেবল সিটি করপোরেশনের পক্ষে মশক নিধন কঠিন।
ডেঙ্গু সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের উদ্যোগ ও ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির পক্ষ থেকে এলাকা ভিত্তিক মশক নিধন কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি পরিচালনা করা হয় বিশেষ অভিযান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধ্বংস করা হয় মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল। এসময় ডেঙ্গু উপদ্রব অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
রাজধানীবাসীর অভিযোগ, গোটা নগরজুড়েই মশার উপদ্রব সহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সূর্য ঢলে পড়তেই ঘরে-বাইরে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ট তারা। আর মশক দমনে করপোরেশনের কার্যক্রমকে ‘নামমাত্র’ আখ্যা দিয়েছেন কেউ কেউ।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে নগরের মশক ঝুকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর নাম উঠে আসে। জরিপ অনুযায়ী, দুই সিটির মোট ১১টি ওয়ার্ডকে মশক ঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে উত্তর সিটির ৫টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ৬টি ওয়ার্ডের নাম উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, উত্তর সিটির ১, ১২, ১৬, ২০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড মশক ঝুঁকিতে রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে দক্ষিণের ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ এবং ৪২ নম্বর ওয়ার্ড।
রাজধানীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা কাওছার হাওলাদারের মতে মশক নিধনে সিটি করপোরেশনকে আরও যুগোপযোগী হতে হবে। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আদাবর এলাকায় খাল আছে, সেখানে মশা হয়। খাল বছরে একবার পরিষ্কার করা হয়। এটি কোনো কাজে আসে না। এই একটা খালের জন্য এই পুরো এলাকার মানুষ সারা বছর ভোগান্তিতে থাকে। এছাড়া যেখানে খাল নাই, সেখানেও মশা। আসলে মশা মারার পদ্ধতি হয়ত ঠিক নেই। আমার মতে, এবিষয়টা নিয়ে আরও একটু ভাবা দরকার।’
একই মত ব্যাংক কর্মকর্তা তাবাসসুম আক্তারের। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘রাতে ঘুমাতে গেলে মশার কয়েল বা এ্যারোসল ব্যবহার করতেই হচ্ছে। তাহলে আমি সিটি করপোরেশনকে কিসের ট্যাক্স দিব?’
রাজধানীরর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মশা জন্মের অন্তত অর্ধ শতাধিক জায়গা শনাক্ত করা গেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্যহারে কিউলেক্স মশা জন্ম নিচ্ছে পয়ঃনিষ্কাশন খালে। আবার বেশির ভাগ খাল পরেছে উত্তর সিটিতে।
তবে সিটি করপোরেশন বলছে, খালের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নয়। বেশির ভাগ খালের মালিক ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু মশক নিধনের দায় সিটি করপোরেশনের। তাই ওয়াসা বা অন্যান্য সংস্থা খাল পরিষ্কার না করলেও সিটি করপোরেশনকে মশক নিধন করতে হয়।
উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বেশির ভাগ খালই সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন না। আমরা বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়েছি, আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিংয়ে আমরা বলেছি। তারা আমাকে কথা দিচ্ছে, কিন্তু তারা কাজ করছে না। তারপরেও আমরা ১৮শ বিঘা খালের মধ্যে প্রায় ১২শ বিঘা খাল পরিষ্কার করেছি। এটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। তবে যার যারটা সে সে করলে কিন্তু সময় সাপেক্ষ হতো না। কারও বাজেটের উপর চাপ পরত না।’
কামরাঙ্গীরচর খাল, হাজারীবাগ খাল সহ বেশ কয়েকটি খাল রয়েছে দক্ষিণ সিটিতেও। ঢাকা ওয়াসা পরিচালকের সঙ্গে এক সভায় বসে দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ওয়াসা খালগুলো পরিষ্কার করবে।
দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার আমরা একটা মিটিং করেছি। সেখানে ওয়াসার চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা খাল পরিষ্কার করবে। কিউলেক্স মশার জন্য খালগুলো, জলাশয়গুলো দায়ী। সবাই ভাবে এটা সিটি করপোরেশনের সমস্যা। কিন্তু সবাই যদি মনে করে, এটা আমাদের সবার সমস্যা। তাহলে এটা সমাধান হবে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, খাল ও জলাধার ছাড়াও নগরের বস্তি, রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড়, ঝোপঝাড়, টায়ারের দোকান, দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা মোটর যান মশা জন্মানোর উপযুক্ত স্থান। এছাড়া ঢালাই মেশিন, রাস্তার পাশে পরে থাকা পলিথিন, কর্কসীট, বিভিন্ন মার্কেটের পরিত্যাক্ত ছাদ, দুই বাড়ির মাঝের পেসেজে বৃষ্টির পানি ও ভবনের টাংকীর পানি জমে সেখানে মশা জন্মাচ্ছে।
নির্মানাধীন ভবনে ঠিকাদার ও বাড়ি মালিকদের অসচেতনায় সেখানে জন্ম নিচ্ছে এডিস ও কিউলেক্স উভয় ধরণের মশা। এসব মশা নিধনে সিটি করপোরেশন কত কার্যকারী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মতে, মশক প্রজনন সক্ষম স্থান ধ্বংসে নির্মাধীন ভবন মালিক ও ব্যবসায়িদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো সাড়া দিচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ‘মশা নিধনে আমরা কাজ করছি। মশার প্রজনন স্থল ধ্বংসে কাজ করছি, টায়ারের দোকান, নির্মানাধীন ভবনগুলোকে আমরা নক করছি। কিন্তু সাড়া পাচ্ছি না। আমাদের নব নির্বাচিত মেয়রের নির্দেশনা অনুযায়ী, আমরা যদি তাদের থেকে সাড়া না পাই, তাহলে জনস্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিব।’
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কের পাশে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এসব পানিতে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধরণের মশা। কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের রাস্তা, বাংলামোটর মোড়, গাবতলি, সায়দাবাদ এরমধ্যে অন্যতম।
মারুফ হোসেন নামের এক পথচারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাস্তার পাশে মশা জন্মাচ্ছে। সেটা কেউ দেখে না। মশার উপদ্রব কতটা বেড়েছে পাবলিক বাসে উঠলে বোঝা যায়। এতো মানুষের মধ্যেও বাসে মশা কামড়াচ্ছে। সিটি করপোরেশন কি কাজ করে? তাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদের মতে, ঢাকার মশার ক্ষেত্রের তুলনায় তাদের জনবল ও সক্ষমতা অপ্রতুল। মশক নিধন শূন্যের কোঠায় না নেয়া গেলেও, সকলের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব।
ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মশার ক্ষেত্র, ওষুধ দিয়ে তা শূন্যের কোঠায় নেয়া সম্ভব না। নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ক্রাশ প্রোগ্রাম হচ্ছে, এটা চলমান কার্যক্রম। মশাকে আমরা একটা লেভেলে রাখার চেষ্টা করব। ঢাকা শহরের মানুষ এবং এলাকার তুলনায় আমাদের সক্ষমতা অপ্রতুল।’
তিনি আরও বলেন, ‘বারবার আমরা একটা কথা বলছি, নগরবাসীকে সম্পৃক্ত হতে হবে। নিজের বাড়ি-অফিস-ব্যবসা প্রতিষ্ঠাননের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটা যদি তারা ঠিক রাখে, তাহলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে।’
নাগরিকদের অভিযোগ মশক নিধনের ওষুধ কাজ করছে না। সম্প্রতি দক্ষিণ সিটির ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রহমান মিয়াজীও একই অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ওষুধ ভাল না হলে আমরা কেন নিব? প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়ায় এর আগে অনেক ওষুধ বাতিল করা হয়েছে।’
দক্ষিণের ৭৫টি ওয়ার্ডে মশক নিধন জোড়ালো করতে এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী এক সপ্তাহ পরে আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি ব্লকে ভাগ করব। কর্মীদেরকে ওয়ার্ডগুলোকে ব্লক আকারে জমি লিখে দেয়ার মতো ভাগ করে দেয়া হবে। একটা ওয়ার্ডে ১০টা ব্লকে ভাগ করা হলে, একেকটা ব্লকে একজন করে কর্মী থাকবে। ওই কর্মীও তার ব্লককে সপ্তাহে ছুটির একদিন বাদ দিয়ে ভাগ করে নিতে পারবে। পুরো বিষয়টা তদারকি করা হবে। এতে করে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো নিশ্চিত হবে।’